শিল্পী চিত্তপ্রসাদ: রাজনৈতিক চেতনার শিল্পকীর্তি

 

Chitta prosad _exhibition 1

কল্পতরু সেনগুপ্ত

চিত্তপ্রসাদ ভট্টাচার্য ভারতবিখ্যাত শিল্পী৷ শিল্পী রূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন চিত্তপ্রসাদ নামে৷ চিত্তপ্রসাদের সঙ্গে আমার পরিচয় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শুরুতে৷ তখন চট্টগ্রামে বোমা পড়ছে, শহরবাসীদের সরে যেতে বলা হয়েছে সরকার থেকে৷ চিত্তপ্রসাদের পরিবারের সকলকে চট্টগ্রামের বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে তিনি একা রয়ে গেলেন চট্টগ্রামের এক গ্রামে৷ তাঁদের আদি বাড়ি মেদিনীপুরে৷ চট্টগ্রামে থাকতেন পিতার কর্ম উপলক্ষে৷ চট্টগ্রাম শহরে তিনি শিল্পী ও সংস্কৃতি-কর্মী হিসাবেই পরিচিত ছিলেন৷ দীর্ঘাকৃতি, গৌরবর্ণ, উন্নত নাসিকা, টানা উজ্জ্বল চোখ, বাবরি চুল দেখলেই চোখে পড়ত৷ তাঁর পোশাকের বৈশিষ্ট্য ছিল সাদাপাড় ধুতি, ঢিলা পাঞ্জাবি, কাঁধে চাদর৷ তাঁদের বাড়িতে গানের চর্চা ছিল, তানপুরা হাতে বোনেদের নিয়ে সঙ্গীত বিদ্যালয়ে যেতেন৷ সকলের চোখে পড়ত৷ আমরা শুনেছিলাম তিনি ছবি আঁকেন, একজন শিল্পী৷ আমাদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় থাকলেও ঘনিষ্ঠতা ছিল না৷ কারণ, আমাদের পেছনে পুলিশের ওয়াচার ঘুরত৷

শহর থেকে দূরে এক বন্ধুর বাড়িতে থাকার সময় তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সাহচর্যে আসেন৷ কমিউনিস্ট পার্টির প্রচারকাজে যুক্ত হয়ে যান৷ জাপানি যুদ্ধবাজদের ব্যঙ্গ করে ছবি আঁকেন, দুর্ভিক্ষের বিরুদ্ধে ছবি আঁকেন, কাঁধে থলে নিয়ে কাগজ-কালি নিয়ে গ্রামে-গ্রামে যান৷ দুর্ভিক্ষের মর্মান্তিক চিত্রগুলি এঁকে রাখেন৷ এই ছবিগুলি নিয়ে চট্টগ্রামের কমিউনিস্ট পার্টি গ্রামে হাটের দিনে ছোটখাটো প্রদর্শনী করত, কর্মীরা যুদ্ধের বিরুদ্ধে এবং দুর্ভিক্ষের বিষয়ে সাবধান করে বক্তৃতা করত৷ তাঁকে দিয়ে পার্টির প্রচারকাজের জন্য স্লোগান ও পোস্টার লিখিয়ে নেওয়া হত৷ চিত্তপ্রসাদ তখন আমাদের একজন হয়ে গেছেন৷

এই পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামে এসেছিলেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক পি সি যোশি৷ কমরেড যোশির নজরে পড়ে চিত্তপ্রসাদের ছবি ও পোস্টার৷ তিনি জানতে চান, এই শিল্পী কে? এবং তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চান৷ চিত্তপ্রসাদকে গ্রাম থেকে শহরে আনা হল৷ যোশি তাঁর আঁকা ছবি ও স্কেচ দেখলেন৷ তার পরে চিত্তপ্রসাদের সঙ্গে একান্তে কথা বলে তাঁকে পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী রূপে গ্রহণ করেন৷ একান্তে আমাদের বললেন, ‘‘এই শিল্পী অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন, তোমরা জেলায় এঁকে কাজে লাগাতে পারবে না, এর প্রতিভা বিকাশে সহায়তা করতে পারবে না৷ আমরা ওঁকে বোম্বাই নিয়ে যাব, পার্টির পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত করে রাখব৷ তার আগে চট্টগ্রামে একটা প্রদর্শনী করো, ‘Defend Chittagong’ বা ‘চট্টগ্রামকে রক্ষা করো’৷ সে সময় কয়েকজন ব্রিটিশ সৈনিক বাধ্যতামূলক সৈনিকবৃত্তি গ্রহণ করে চট্টগ্রামে এসেছিলেন৷ তাঁরা ছিলেন লন্ডনের আর্ট স্কুলের শিক্ষক৷ তাঁদের এই প্রদর্শনীর কাজে যুক্ত করা হল৷ তাঁদের কাছ থেকে আধুনিক অঙ্কনবিদ্যা ও রং-এর ব্যবহার চিত্তপ্রসাদ গ্রহণ করেন৷ একই সময়ে ছিপছিপে রোগা গড়নের সোমনাথ হোর এই কাজে যোগ দেন৷ তাঁকে তাঁর মা গ্রাম থেকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন এবং কমরেড যোশির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন৷ তাঁর মা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন৷ তার আগে তিনি বিপ্লবী দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং সমস্ত অলঙ্কার বিপ্লবীদের দিয়েছিলেন৷ যোশি সোমনাথ হোরের সঙ্গে কথা বলে এবং তাঁর সামান্য কিছু কাজ দেখে আমাদের বলেছিলেন, তোমাদের জেলা সৌভাগ্যবান, এই তরুণ আরেক প্রতিভা৷ একে আমি কলকাতায় নিয়ে আর্ট কলেজে ভর্তি করাবার ব্যবস্থা করব৷ আপাতত এখানে ‘ডিফেন্ড চিটাগাং’ প্রদর্শনীর জন্য ছবি আঁকুক৷ ‘ডিফেন্ড চিটাগাং’ প্রদর্শনী চলেছিল এক সপ্তাহ৷ কমরেড পি সি যোশি উদ্বোধন করেছিলেন, চট্টগ্রামের কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের নেতারা উপস্থিত ছিলেন৷ রোজ দলে-দলে সৈনিকরা আসত, জনসাধারণ আসত৷ এই প্রদর্শনীতে প্রথম প্রদর্শিত হয় চিত্তপ্রসাদ ও সোমনাথ হোরের আঁকা ছবি৷ আরো উল্লেখ্য যে, চিত্তপ্রসাদের একটি ছবি নিলামে দশ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছিল৷ অবশ্য সেই টাকা চিত্তপ্রসাদ রিলিফ ফান্ডে দান করেছিলেন৷ যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষ ধ্বংসের প্রতীক, কিন্তু তার ভস্মরাশি থেকে যে হীরকখণ্ড বেরিয়ে আসতে পারে, এই দুই শিল্পী তার সাক্ষী৷ এই হীরকদ্যুতিতে আজ ভারতের শিল্পজগৎ নতুন ঠিকানা পেয়েছে, দেশবাসী গর্বিত৷

চিত্তপ্রসাদকে প্রথমে কলকাতায় কিছুদিন রাখা হয়েছিল৷ বিশিষ্ট শিল্পীদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয় এবং নতুন-নতুন ছবি আঁকেন৷ তাঁর ছবির সাফল্য এবং অসাধারণ শক্তিশালী রেখা দর্শকদের অভিভূত করে৷ একটা বক্তব্য পৌঁছিয়ে দেয়৷ তার পরে তিনি বোম্বাইতে পার্টির মুখপত্র ‘পিপলস ওয়ার’-এ শিল্পী রূপে যোগ দেন৷ এই কালে ভারতের রাজনীতিতে জটিল অবস্থা৷ এক দিকে জনযুদ্ধ সম্পর্কে ভুল বোঝাবুঝি, আরেক দিকে জাতীয় রাজনৈতিক নেতাদের দোদুল্যমানতা, একদিকে অগাস্ট আন্দোলন, সৈনিক বিদ্রোহ থেকে নৌ বিদ্রোহ৷ এই বিদ্রোহী ভারতের চিত্র চিত্তপ্রসাদের তুলি ও কাগজে যে-ভাবে ধরে রাখা হয়েছে, তার তুলনা নেই৷ সেদিনের পরিস্থিতি কবি সুকান্তের কবিতায় যেমন প্রতিফলিত হয়ে স্বাধীনতার চূড়ান্ত সংগ্রামের ডাক দিয়েছে, তেমনি বিদ্রোহী ভারতের আত্মা প্রতিফলিত হয়েছে চিত্তপ্রসাদের ছবিতে৷

চিত্তপ্রসাদের প্রতিভার আরেক দিক তার রাজনৈতিক ব্যঙ্গচিত্র৷ গভীর রাজনৈতিক চেতনা ও অনুভূতি না থাকলে এবং সর্বোপরি আদর্শগত বিশ্বাস না থাকলে এরূপ ছবি আঁকা সম্ভব নয়৷ ব্রিটিশের জালিয়াতি, সাম্রাজ্যবাদী ফাঁদ এবং চক্রান্ত, তার সঙ্গে জাতীয় নেতাদের মূর্খামি এই ছবিগুলিতে প্রকাশ পেয়েছে৷ যে স্বাধীনতা আসছে, সেটা যে সাম্রাজ্যবাদী বর্মটাকে পালিশ করে চকচকে নতুন দেখিয়ে উপস্থিত করা হচ্ছে মানুষকে বোকা বানিয়ে– চিত্তপ্রসাদ অসীম সাহসে সেই কথা বলেছেন ব্যঙ্গের মাধ্যমে৷ কূটকৌশলী ব্রিটিশের শেষ চাল ছিল ‘অপারেশন এসাইলাম’৷ জাতীয় নেতাদের হত্যা করার চক্রান্ত৷ এই চক্রান্ত ফাঁস করে দিয়েছিলেন মেজর জয়পাল সিং৷ এই চক্রান্তের ব্লুপ্রিন্ট ‘পিপলস ওয়ার’ পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছিল৷ তার জন্য ভারতব্যাপী চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছিল৷ চিত্তপ্রসাদ এই চক্রান্তকে ছবিতে উপস্থিত করেছিলেন ‘অপারেশন এসাইলাম’ নামে৷ এটি চিত্তপ্রসাদের শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক চিত্র৷

দুর্ভিক্ষ থেকে রাজনৈতিক চিত্র, রাজনৈতিক চিত্র থেকে রাজনৈতিক কার্টুনচিত্র অঙ্কনে চিত্তপ্রসাদ যে-রূপ রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও অঙ্কনকুশলতার পরিচয় দিয়েছেন, তার তুলনা নেই৷ একজন অভিজ্ঞ রাজনৈতিক, এক দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ-বিশ্বাসীর চেতনাকে তিনি প্রকাশ করেছেন তাঁর কল্পনা ও তুলির টানে৷ তাঁর তুলির টান অসাধারণ শক্তিশালী, তার মধ্যে জনগণের শক্তি, ঐক্য ও বিশ্বাস প্রতিফলিত হয়েছে৷ মানুষকে যা উদ্বুদ্ধ করে, এগিয়ে চলতে সাহস জোগায়৷

বর্তমান প্রজন্ম চিত্তপ্রসাদের ছবির সঙ্গে পরিচিত নন, তাঁরা এই ছবিগুলি দেখে বুঝবেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে শিল্পীর কী ভূমিকা ছিল৷ শিল্প রাজনীতি-বহির্ভূত নয়, মানুষের সংগ্রাম ও চেতনার প্রতিফলন৷ চিত্তপ্রসাদের আঁকা স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায় এবং সেই পরিস্থিতিতে তাঁর নির্ভীক বক্তব্য আমাদের বিস্মিত করে৷ আমরা তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাবনত হই৷

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তির কালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের গণমাধ্যম কেন্দ্র এই প্রদর্শনীর আয়োজন করার জন্য শিল্পপ্রেমীদের ধন্যবাদভাজন হবেন৷ আমরা ধন্যবাদ জানাই চিত্তপ্রসাদের ছোট বোন শ্রীমতী গৌরী চট্টোপাধ্যায়কে৷ চিত্তপ্রসাদের শিল্পকীর্তি তিনি সযত্নে আগলে রেখেছেন বলে আমরা এত মূল্যবান একটি প্রদর্শনী দেখতে পারছি৷

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *